রসায়ন (Chemistry)
বিজ্ঞানের যে শাখায় পদার্থের গঠন (কাঠামো), পদার্থের ধর্ম (ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম) ও পদার্থের পরিবর্তন (ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তন) নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে রসায়ন (Chemistry) বলে।
রসায়ন হল বিজ্ঞানের একটি শাখা যা পদার্থের উপাদান এবং পদার্থের বৈশিষ্ট্য, গঠন, পদার্থের ধর্ম(ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম) এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় মাধ্যমে কীভাবে পদার্থের গঠন পরিবর্তন হয় এবং যখন পরিবর্তিত হয় তখন কি পরিমাণ রাসায়নিক শক্তি বা তাপশক্তি নির্গত বা শোষিত হয় এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
রসায়ন শব্দের উৎপত্তি
রসায়ন শব্দের ইংরেজি Chemistry (কেমিস্ট্রি)।অনেক বছর আগে প্রায় মধ্যযুগে পরশ পাথরের সন্ধানে পরীক্ষারত মুসলিম বিজ্ঞানীরা একটি শাস্ত্র বা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, এটাকে তারা বলতেন আলকামিস্তা বা আলকেমি(Alchemy) ।
আলকেমি শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ আল-কিমিয়া(Alchemia) থেকে। আবার এই আল-কিমিয়া(Alchemia) শব্দটি এসেছে ‘কিমি’ থেকে। কিমি(Chemy) থেকেই chemistry শব্দের উৎপত্তি।
আলকেমি আল অর্থ দি(The), এবং কেমি বা কিমি অর্থ ব্লাক সয়েল(black soul) বা কালো মাটি। এই কালো মাটি প্রকৃত পক্ষে মিশরের নীল নদের তীরের মাটি। প্রাচীন মিশরকে রসায়ন বিজ্ঞানের জন্মক্ষেত্র বলা যায়।
কারণ, মিশরীয়রা সভ্যতার আদি লগ্নে যে মমি তৈরি করতো তাতেই তারা নানা রকমের রাসায়নিক(Chemical) পদার্থ ব্যবহার করতো। প্রাচীন গ্রীসেও রসায়নের চর্চা শুরু হয়েছিলো সুপ্রাচীনকাল থেকেই।
রসায়নের শাখাসমূহ
রসায়নকে মুলত পাঁচটি শাখায় অধ্যয়ন করা হয় –
1. জৈব রসায়ন (Organic Chemistry)
2. অজৈব রসায়ন (Inorganic Chemistry)
3. ভৌত রসায়ন (Physical Chemistry)
4. বিশ্লেষণী রসায়ন (Analytical Chemistry)
5. প্রাণরসায়ন (Biochemistry
জৈব রসায়ন (Organic Chemistry) কি?
রসায়নের যে শাখায় হাইড্রোকার্বন ও এর জাতকসমূহের গঠন, ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম, রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে বিসদ গবেষণা ও আলোচনা করা হয় রসায়নের সেই শাখাই হল জৈব রসায়ন(Organic Chemistry)।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জৈব রসায়নের অসামান্য অবদান রয়েছে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা জৈব রসায়নকে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি যেমন- টুটপেস্ট, সাবান, রং, প্লাস্টিক, খাদ্যসামগ্রী, ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদনের পাশাপাশি বিস্ফোরক, ঔষধ, প্রসাধনী ও জ্বালানিরূপেও জৈব যৌগসমূহের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
বেশিরভাগ জৈব যৌগগুলিতে সাধারণত কার্বন(C) এবং হাইড্রোজেন(H) থাকে, তবে এই হাইড্রোকার্বনের সাথে অন্যান্য উপাদানগুলি(যেমন-অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হ্যালোজেন, ফসফরাস, সালফার, সিলিকনইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
অজৈব রসায়ন (Inorganic Chemistry) কি?
রসায়নের যে শাখায় কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণু বাদে অন্য অজৈব পদার্থ(যা জীব থেকে পাওয়া যায় না) নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা ও গবেষণা করা হয় তাই হলো অজৈব রসায়ন। সহজ কথায়, এটি জৈব রসায়নের বিপরীত।
অর্থাৎ যেসব পদার্থে কার্বন-হাইড্রোজেন বন্ধন নেই সেগুলো হলো ধাতুসমূহ, লবণসমূহ, রাসায়নিক পদার্থসমূহ ইত্যাদি।
ভৌত রসায়ন (Physical Chemistry) কি?
ভৌত রসায়ন হল ভৌত জগতে রসায়নের যা কিছু ঘটে যেমন- গতি, বল, সময়, শক্তি, তড়িৎশক্তি, তাপগতিবিদ্যা, কোয়ান্টাম রসায়ন, পরিসংখ্যানগত বলবিদ্যা, বিশ্লেষণাত্মক গতিবিদ্যা এবং রাসায়নিক ভারসাম্যের মতো পদার্থবিদ্যার নীতি, অনুশীলন এবং ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাসায়নিক কণার ঘটনাগুলির অধ্যয়ন।
বিশ্লেষণী রসায়ন (Analytical Chemistry)
রসায়নের এই শাখায় রাসায়নিক পদার্থকে সনাক্ত করতে, আলাদা করতে ব্যবহৃত যন্ত্র এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিমাপ করতে বিশ্লেষণাত্মক রসায়ন অধ্যয়ন করা হয়।
প্রাণ রসায়ন (Biochemistry) কি?
বায়োকেমিস্ট্রি হল বিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে এবং সম্পর্কিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলি অন্বেষণ করা হয় এবং এইসব বিষয় নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা করা হয়।
বায়োকেমিস্ট্রি হল একটি পরীক্ষাগার ও গবেষণা ভিত্তিক বিজ্ঞান যা জীববিজ্ঞান(Biology) এবং রসায়ন(Chemistry) কে একত্রিত করে।
রসায়নের জনক কে | আধুনিক রসায়নের জনক কে
বর্তমান পৃথিবীর উন্নয়নের মূলে রসায়নের ভূমিকা অপরিসীম। পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পৃথিবীর উন্নয়নে অনেক বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
ইতিহাসে রসায়নের আবিষ্কার এবং এর প্রভাব অনেক দীর্ঘ তাই অনেকে রসায়নের প্রকৃত আবিষ্কারক কে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভবপর নয়।
তবে প্রাচীন রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান, এই মুসলিম রসায়ন বিজ্ঞানের হাত ধরে রসায়নশাস্ত্র অনেক বেশি বিকশিত হয়েছিল।
আর আধুনিক রসায়নে অনেক বেশি অবদানের জন্য আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের জনক বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে।
রসায়নের ক্ষেত্রসমূহ
রসায়নের বিস্তৃতি ব্যাপক। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সকল কর্মকাণ্ডে রয়েছে রসায়ন।
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের নিঃশ্বাসে গৃহীত বায়ু, পানি, খাবার,গাছে ফল পাকা, লোহায় মরিচা ধরা, আগুন জ্বালানো, পরিধেয় বস্ত্র, গৃহস্থালি ও শিক্ষা সরঞ্জাম, কৃষি, যোগাযোগ সবকিছুতেই রসায়ন এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা জীব রাসায়নিক প্রক্রিয়া অতপ্রোতভাবে জড়িত।
রসায়ন পাঠের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বিশ্বে মানুষের সকল ধরনের মৌলিক চাহিদার উপকরণ জোগানো থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার মানুষের জীবনকে করেছে সহজ ও সুন্দর।
নিচে রসায়নের অন্তর্গত কতিপয় রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার দ্বারা রসায়ন পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়।
যেমন- রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কীটনাশক পোকামাকড়ে শস্যহানি থেকে প্রতিরোধ করতে, কয়েল বা অ্যারোসল মশা তাড়াবার কাজে, সাবান, ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু পরিষ্কার করার কাজে প্রতিনিয়ত রসায়নের প্রয়োগ রয়েছে।
তাছাড়াও ঔষধ, অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন শরীর ও স্বাস্থ্যরক্ষায়, কাঁচা হলুদ, মেহেদি, কসমেটিকস, রং সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে এবং ভেষজ ওষুধপত্র স্বাস্থ্যরক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে রসায়ন প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশ্নঃ পেঁপে পাকলে হলুদ হয় কেন?
উত্তরঃ রং এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। পেঁপে পাকলে এর মধ্যে জীব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হলুদ বর্ণধারী নতুন যৌগের সৃষ্ঠি হয়। এজন্য পেঁপে পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
প্রশ্নঃ ফল পাকলে মিষ্টি হয় কেন?
উত্তরঃ পাকা ফলে চিনি থাকে। তাই পাকা ফল মিষ্টি লাগে। কাচা ফলে জৈবিক এসিড থাকে। পাকা ফল জৈবিক এসিড চিনিতে পরিবতির্ত হয়। ফলের প্রধান শেতসার স্টার্চ। স্টার্চ মিষ্ট নয়। ফল পাকলে স্টার্চ চিনিতে পরিণত হয়। তাই পাকা ফল সাধারণত খেতে মিষ্টি লাগে।
প্রশ্নঃ কাচা ফল টক লাগে কেন?
উত্তরঃ কাচা ফলে চিনি থাকে না। পাকা ফল চিনি থাকে। তাছাড়া কাচা ফলে বিভিন্ন প্রকার জৈব এসিড যেমন অ্যাসকরবিক এসিড ফরমিক এসিড টারটারিক এসিড এবং কোনো কোনো ফলে সামান্য পরিমাণে অজৈব এসিডও পাওয়া যায়। কাচা ফলে এর পরিমাণ কম থাকে। তাই কাচা ফল টক হয়।
প্রশ্নঃ সবুজ ফল লাল হওয়ার কারণ কী?
উত্তরঃ সবুজ ফল পেকে হয় হলুদ সবুজ টমেটো পেকে হয় লাল সবুজ কমলালেবু পেকে কমলা রং ধারণ করে। ফল যখন পাকা অবস্থার দিকে অগ্রসহর হয় তখন ফলের ক্লোরোকপ্লাস্ট ক্যারোটিন সমৃদ্ধ ক্রোমোপ্লাস্ট রুপান্তরিত হয় এবং জ্যান্থেতাফিল নামক ক রঞ্জন পদার্থের আগম ঘটে।
ফলে রঙের পরিবর্তন ঘটে। লাইকোপিন বেশি হলে সবুজ ফল লাল রং ধারণ করে।
জেনে রাখা ভালো
১. প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সময়ের রসায়ন চর্চা ‘আল-কেমি’ নামে পরিচিত।
২. আল-কেমি শব্দটি আরবি শব্দ ‘আল-কিমিয়া’ থেকে উদ্ভূত, যা দিয়ে মিশরীয় সভ্যতাকে বোঝানো হয়।
৩. কার্বন যৌগের দহন এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া। এর ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস, জলীয়বাষ্প
ও তাপশক্তি উৎপাদন হয়।
৪. আম পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করা একটি জীবরাসায়নিক প্রক্রিয়া।
৫. মরিচা হলো লোহার অক্সাইড যা জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিতে বায়ুর অক্সিজেনের সাথে রাসায়নিক
বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়।
৬. বিশুদ্ধ পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত। খাবারের পানিতে অন্যান্য খনিজ লবণও
থাকে।
৭. উদ্ভিদ (সালোকসংশ্লেষণ) ও প্রাণী বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন ও সঞ্চয় করে।